মুছাকেও মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন বাবুল!

18 May 2021, 10:38:18

স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করিয়ে নিজের সোর্স মুছাকেও মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন পুলিশের সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। মিতু হত্যার পর দুই সপ্তাহ ধরে তিনি মুছাকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। দিয়েছিলেন সতর্ক থাকার পরামর্শও। মুছার স্ত্রীর দাবি, যখন মুছা ধরা পড়ে যান, তখন তাঁকেও মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবুল।

২০১৬ সালের ২১ জুন সকালে যখন মুছা ধরা পড়েন, তখন চট্টগ্রামে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বাবুল বলেছিলেন, ‘এমন খুনিকে এক মুহূর্তও kalerkanthoবাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না।’ কিন্তু ওই সময় পুলিশ কর্মকর্তারা বাবুল আক্তারের এমন নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেননি। উল্টো তৎকালীন সিএমপি কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহির বিষয়টি বাবুলকে স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু বাবুল বারবার বলেছিলেন, ‘রাখো তোমার কমিশনার, তোমরা আমার জন্য এটুকুই করবে না? আমি তোমাদের জন্য এত কিছু করেছি। তোমরা গুরুদক্ষিণা দেবে না?’

বাবুল গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। আর মুছাকে সতর্ক থাকার জন্য বাবুল নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার। তিন মাস আগে থেকেই বাবুল স্ত্রী হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন, এমন তথ্য দিয়েছেন হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহকারী এহতেশামুল হক ভোলা। অবশ্য তিনি আদালতে এমন স্বীকারোক্তি দেননি। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে অন্য একটি হত্যা মামলায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এমন দাবি করেছিলেন ভোলা।

গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার বলেন, ‘মিতু হত্যার দু-তিন দিন পর মুছা বাসায় ফোন রেখে বের হয়েছিলেন। এই সময় ল্যান্ডফোন থেকে একটি কল আসে, সেই কলটি আমি রিসিভ করি। অন্যপ্রান্ত থেকে যিনি ফোন করেছিলেন তিনি তাঁর পরিচয় দেননি। তিনি মুছা কোথায় জানতে চান, আমি বলেছিলাম, মুছা বাইরে। এরপর আবার জিজ্ঞেস করেন, মুছা কি বাসার বাইরে? তখন আমি বলি, হ্যাঁ, বাসার বাইরে। তখন তিনি বলেন, মুছাকে বলবা একটু সতর্ক থাকতে। এই বলে ফোন রেখে দেন।’

পান্না আক্তার বলেন, ‘আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, অন্যপ্রান্ত থেকে কথা বলেছেন বাবুল আক্তার। পরে আমি মুছার কাছে জানতে চাই, তোমাকে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে কেন? তুমি কি কোনো অপরাধে জড়িয়েছ? তখন মুছা বলেছিল, বাবুলের নির্দেশে কাজটি সে করেছে। মুছা আরো বলেছিল, এই বিষয়ে কখনোই কারো কাছে মুখ না খুলতে। যদি তিনি (পান্না) মুখ খোলেন, তাহলে মুছার ক্ষতি হয়ে যাবে।’

এত দিন পর কেন এসব কথা বলছেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে পান্না বলেন, ‘মুছাকে প্রশাসনের লোকজন আটক করে নিয়ে গেছে। এত দিন আশায় ছিলাম মুছা ফিরে আসবে। কিন্তু মুছা এখনো ফিরে আসেনি। আবার বাবুল আক্তার এখন আর মামলার বাদী নেই, তিনিও আসামি হয়েছেন।’ তাহলে মুছা কোথায়? এই প্রশ্নের জবাবে পান্না বলেন, ‘আমি এখনো বলছি। মুছাকে প্রশাসনের লোকজন নিয়েছে আমার সামনে থেকেই। মুছাকে এখনো আদালতে সোপর্দ করা হয়নি। আমি মুছাকে আদালতে সোপর্দ করার দাবি জানাচ্ছি।’ আপনি কি মনে করছেন মুছা এখনো জীবিত আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের লোকজন কেন মুছাকে মারবে, প্রশাসন তো মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা। তাই আমি এখনো মনে করি, প্রশাসনের কাছে মুছা আছে এবং তাকে আদালতে সোপর্দ করা হবে।’

তিন মাস আগে মিতু হত্যার পরিকল্পনা : ২০১৫ সালে মিশন শেষ করে সুদান থেকে দেশে ফেরার পর মিতুর সঙ্গে বাবুলের দাম্পত্য কলহের মাত্রা বাড়ে। ওই সময় মিতু বাবুলের মোবাইল ফোনে গায়ত্রীর পাঠানো বার্তাগুলোর বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। আবার ২০১৬ সালের শুরুর দিকে বাবুল প্রশিক্ষণের জন্য চীন গিয়েছিলেন। তখন বাসায় দুটি বই পান মিতু, যে বইগুলো বাবুলকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন গায়ত্রী। বই দুটিতে গায়ত্রী ও বাবুলের হাতে লেখা ছিল। সেই লেখা পড়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মিতু। সুদান থেকে ফিরে এক দফা স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি এবং চীন প্রশিক্ষণ শেষে বইয়ে বাবুল-গায়ত্রীর হাতের লেখা নিয়ে আবার সাংসারিক কলহ শুরু হলে একপর্যায়ে নিজের সোর্স মুছা সিকদারের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেন বাবুল। তারপর মুছাকে দিয়ে মিতুকে হত্যার ছক কষেন বাবুল।

হত্যা পরিকল্পনা হয়েছিল খুনের তিন মাস আগে। এমনটাই জানিয়েছিলেন অস্ত্র সরবরাহকারী এহতেশামুল হক ভোলা। তিনি ২০১৮ সালে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তখন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে অন্য একটি হত্যা মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখায়। সেই মামলায় রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা পুলিশ। ওই সময়ই চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে বসে মিতু হত্যার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন ভোলা। এখন ভোলা জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগারের বাইরে আছেন।

‘গুরুদক্ষিণা’ চেয়েছিলেন বাবুল : মিতু হত্যার পরপরই মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহী ঘটনাস্থল থেকে গোলপাহাড় মোড়ের দিকে চলে যাওয়ার ছবিসংবলিত সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পেয়েছিল পুলিশ। ওই সময় দেশের সব স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে ওই দৃশ্য প্রচারিত হয়েছিল। মোটরসাইকেল আরোহীর তিনজনের একজন বাবুল আক্তারের সোর্স মুছা সিকদারকে চিনতে পেরেছিলেন চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালনরত একাধিক পুলিশ পরিদর্শক। এ কারণেই ঘটনার দুই দিন পরই মুছাকে ফোন করে পিবিআই চট্টগ্রাম কার্যালয়ে দেখা করার জন্য বলেছিলেন ওই সময়ে চট্টগ্রাম পিবিআইয়ে কর্মরত এক চৌকস কর্মকর্তা। কিন্তু বাবুল কখনই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেননি, ‘ভিডিও ফুটেজে দেখা যাওয়া তিনজনের একজন তাঁর সোর্স মুছা। বরং তিনি মুছাকে রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।’

এদিকে গতকাল পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তি না দিয়ে বাবুল আক্তার আপাতত নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তিনি স্ত্রী হত্যায় ফেঁসেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বাবুলের এক সহকর্মী। তিনি বলেন, শিষ্যের কাছে গুরুদক্ষিণা চাওয়া, মুছাকে ওই সময় পিবিআই কার্যালয়ে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া, একটি ভয়েস রেকর্ড ফাঁস হওয়া, সর্বশেষ ব্যাবসায়িক অংশীদার সাইফুল হকের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা বিকাশে খুনিদের কাছে পাঠানোর কথা স্বীকার করেছেন বাবুল। পাশাপাশি পাঁচ হাজার ও ৭০ হাজার টাকা খুনিদের নগদে দেওয়া এবং মুছাকে নিজের সোর্স বলে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাবুল কার্যত ফেঁসে গেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার এবং ভোলা যখন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবে, তখন হত্যারহস্য আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।