লক্ষ্য সব রক্ষায়, চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে

4 June 2021, 10:11:16

দেড় বছর ধরে মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পৃথিবী। ক্ষুদ্র এক ভাইরাস জীবন-জীবিকা আর অর্থনীতির সব হিসাবই পাল্টে দিয়েছে। অতি সংক্রামক ভাইরাসটির সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়াই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এমন কঠিন এক বাস্তবতায় আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে দেশের ৫০তম আর আওয়ামী লীগ সরকারের ২১তম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার তৃতীয় বাজেট পেশ করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেয়।

করোনাকালের বাস্তবতাকে সামনে রেখে ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জীবন ও জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৃষি খাত।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে করোনাকালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা রয়েছে। যদিও মানুষকে নিরাপদ রেখে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ঘাটতি সেখানে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবারের বাজেটে দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ঝুঁকি তৈরির পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধের মাধ্যমে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করে যেতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে আমরা দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, জাতীয় বাজেটে সাধারণত আমরা সুসংহতভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার রূপরেখা প্রণয়ন করে থাকি। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এবছরও সব তথ্য-উপাত্ত পরিপূর্ণভাবে আমাদের সামনে নেই।

মুস্তফা কামাল বলেন, শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক অভিঘাত মোকাবিলা করে বাংলাদেশ যখন অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক উত্তরণের পথে এগিয়ে চলছিল, তখনই সারাবিশ্বে করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিঘাত শুরু হয়। যার প্রভাব সর্বত্রই প্রবল। এজন্য আমাদের এবারের বাজেটেও দেশ ও জাতির উন্নয়নের পাশাপাশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন-জীবিকা।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ বদলে গেলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জাতির জীবনে সর্বক্ষেত্রে তার সজীব উপস্থিতি রয়েছে। তার নির্দেশিত পথেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। এ বছরই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীর দুই বলিষ্ঠ প্রবাহের মিলনমেলায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ। এর হাত ধরেই বিশ্বসভায় বাংলাদেশ স্থান পেয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়।

বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোভিড মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে প্রায় ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছি। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পেতে যাচ্ছি।

মন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি করোনা টিকা কেনার জন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ভ্যাকসিন সাপোর্ট পেতে যাচ্ছি। বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির হার কম থাকা ও সার্বিকভাবে ঋণ সক্ষমতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কোনো সংশয় না থাকায় বিপুল বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া অনেকটাই সহজ হয়েছে।

করোনা মহামারি প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ঝুঁকি তৈরি করেছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে আমাদের এখন স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বাড়ানো ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধের মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর মোকাবিলা করে যেতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জীবন ও জীবিকায় প্রাধ্যান্য দিয়ে আমরা দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

অর্থমন্ত্রী বলেন, গত ১২ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য দূর করে ও স্বল্পোন্নত দেশের তলিকা থেকে বেরিয়ে একটি উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে যাত্রা করেছে। কিন্তু জাতীয় জীবনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে করোনভাইরাসজনিত সংকট আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্যান্য আর্থ সামাজিক উন্নয়নের গতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, মুজিববর্ষ ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বছরটি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন শুধু আনুষ্ঠানিকতা সবর্স্ব নয়, এই উদযাপনের লক্ষ্য হলো, জাতির জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করা; জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যের সামান্য অংশই পাঠ করেন। এর বড় একটি অংশ তিনি ডিজিটাল প্লাটফর্মে ভিডিও আকারে উপস্থাপন করেন। অর্থমন্ত্রীর অনুরোধে তার ১৯২ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তব্য ‘পঠিত’ বলে সংসদে গৃহীত হয়।

বাজেটের অংক

আগামী অর্থবছরের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় তিন লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় দুই লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা করা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা (অনুদান ছাড়া) হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এবার ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। সাধারণত ৫ শতাংশের বেশি ঘাটতির পরিকল্পনা করা হয় না। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক অর্থায়ন থেকে ঋণ নেয়া হবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ছে

আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ছে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া কারো ভাতা বাড়ছে না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ২০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। তবে ভাতা না বাড়লেও আওতা বাড়ার কারণে বরাদ্দ এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আগামী অর্থবছর এ খাতে এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেটে ১৫০ উপজেলার বয়স্কদের ভাতার আওতায় আনা হয়েছে।

যত ধনী তত কর

আয়কর আদায় বাড়াতে নতুন বাজেটে ধনীদের ওপর নজর দিয়েছে সরকার। করোনাকালে সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে সমাজে যারা বিত্তবান, তাদের কাছ থেকেই বেশি কর আহরণের জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পদশালীদের ওপর সারচার্জ বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে সারচার্জ আদায় প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। বর্তমানে সর্বনিম্ন নিট সম্পদ মূল্য তিন কোটি টাকা পর্যন্ত সারচার্জমুক্ত এবং ন্যূনতম সারচার্জ বছরে তিন হাজার টাকা। সাতটি স্তরে প্রযোজ্য হারে সারচার্জ আদায় করা হয়।

নারী উদ্যোক্তাদের আয়করে ছাড়

নারী উদ্যোক্তারা আয়করে আরও ছাড় পাচ্ছেন। দেশে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। তবে জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়লেও এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও বাড়েনি ব্যক্তিশ্রেণরীর করমুক্ত আয়সীমা। প্রস্তাবিত বাজেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় আবারও অঙ্গীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য ১০ বছর কর ছাড় দেয়ার প্রস্তাব করেছেন তিনি।

এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। যেখানে প্রায় এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। ইতোমধ্যে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। নয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন এবং ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে বলে প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।